সোমবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০০৮

মৃত্যু-লটারি

প্রতিদিনের মতই লটারির টিকিটের নম্বরটা গুণতে গুণতে হাঁটি হাঁটি পা পা করে আমি টিউশনিতে যাচিছ। বাসা থেকে বের হবার সময় শয্যাশায়ী মা বলেছিলেন, "বাবা, একটু তাড়াতাড়ি ফিরিস, মনটা কেমন যেন করছে।" গত দুই বছর ধরে শয্যাশায়ী মা, আদরের ছোটবোন আর আমি, তিনজনের ছোট্ট সংসারের ভারটা আমাকেই বইতে হয়। নিজের ভার্সিটির খরচ, ছোটবোনের পড়াশুনা, মায়ের চিকিৎসা- এসবের একমাত্র অবলম্বন আমার টিউশনি।বাবার মৃত্যুর এক বছরের মধ্যেই, সংসারের খরচ যোগানোর প্রচণ্ড পরিশ্রমে মায়ের ডান কিডনীতে ব্যাথ্যা শুরু হয়। এখন দু বছরে প্রায় দুটো কিডনীই অচল! হয়ত মা আর বেশি দিন বাঁচবে না। ডাক্তার বলেছিলো, মাকে পুরো সুস্হ করতে প্রায় ২০-২৫ লাখ টাকা লাগবে। কথাটা শোনার পর থেকেই আমার লটারি কেনার শুরু, ৪০ লাখ টাকার লটারি, যদি লাইগ্গা যায়!! বলা যায়, মায়ের জীবন নিয়ে লটারি খেলছি!একবার প্রায় মিলেও গিয়েছিলো, শুধু শেষের ডিজিটটা.........., হতভাগা সন্তান আমি!!
বড়লোকের নার্সারিপড়ুয়া মেয়েকে পড়াই আমি, মাস মাইনে ৬০০০ টাকা, আমাদের অবলম্বন। কিছুক্ষণ পড়ানোর পড়েই মেয়েটা বলল,"স্যার, আপনার লটারি মেলাবেন না? আজতো পেপারে লটারি ড্র'র রেজাল্ট দিয়েছে।" আমার লটারির খবর এদেরও অজানা নেই, শুধু লটারি কেনার কারণটাই কেউ জানে না। মনটা ছটফট করে উঠলেও শীতল কণ্ঠে বললাম, মেলাব। "তাহলে আপনি লটারি মেলাতে যান, আমি গিয়ে কার্টুন দেখি," বলেই মেয়েটা চলে গেল। আমি ছুটলাম পাবলিক লাইব্রেরির দেয়ালে টাঙানো পেপারটার উদ্দ্যেশে। পথেই দেখা নীলার সাথে...
: মা কেমন আছে? জানতে চাইল ও।
-ভাল।
:তোমাদের ওখানেই যাচ্ছিলাম, তুমি বাসায় যাবে না? চলো ... ...।
-তুমি যাও, আমি একটু পরে আসছি।
বড়লোক বাবার একমাত্র মেয়ে নীলা; আমাকে একদিন বলেছিলো, "আমি তোমাকে ভালবাসি।তুমি আমাকে ভালবাসার অধিকারটা দেবে?" আমি ওকে পুরো অবস্থাটা বোঝালাম, তারপর বললাম,"তা হয় না।" তারপর থেকেই আমাদের বাড়িতে ওর আসা-যাওয়া। মাঝে মাঝে মায়ের জন্যে কিছু ওষুধ নিয়ে আসা, পাশে বসা, মায়ের হাত ধরে কিছু কথা বলা ... ...। মাও ওর সঙ্গটা বেশ উপভোগ করে। আমি ওকে আসতে নিষেধ করি, মনে করিয়ে দেই,"আমি কখনোই তোমাকে ভালবাসি নি, এখনো বাসি না।" তবুও ও আসে। হয়ত এখনো ভালবাসে আমাকে। মন থেকে ওর ভালবাসাটা আজও মেনে নিতে পারি না, কারণ সেটা সাজে না। মায়ের চিকিৎসার টাকাটাও দিতে চেয়েছিলো দু'একবার, রাজি হইনি। যাকে ভালবাসি না, তার ভালবাসার সুজোগ নিয়ে প্রতারণার টাকায় মায়ের চিকিৎসা করাতে বিবেক সায় দেয়নি। তবে আজ কেন যেন মনে হচ্ছে, আর কোন পথ খোলা নেই, এবার নীলার কাছেই চাইব টাকাটা। ভাল নাইবা বাসলাম, টাকাটাতো পাব, মায়ের চিকিৎসাতো হবে। এসব ভাবতে ভাবতে চলে এলাম পাবলিক লাইব্রেরির সামনে। নাহ, মিলল না প্রথমটা। ৪০ লাখ গেল ... ... । তবে অবিশ্বাস্য হলেও সত্য ২৫ লাখ টাকার ২য় পুরস্কারের নম্বরটা আমার মিলে গেল। হাসবো না কাঁদবো, বুঝলাম না। আনন্দে লাফাতে লাফাতে দীর্ঘ দেড় বছর পরে আজ রিকসায় উঠলাম; গন্তব্য: বাসা, শয্যাশায়ী মায়ের মুখ।


কী ব্যাপার? এত ভীড় কেন?
ভীড় ঠেলে ছোটবোনটা এগিয়ে এল, "ভাইয়া, মা আর নেই... ...।"
আমি শুধু জানতে চাইলাম, "কখন গেলরে?"
"অনেকক্ষণ তোর নাম ধরে ডাকছিলো, শেষ পর্যন্ত আর থাকতে পারল না ... ...," ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল ও।
আমি ভেতরে এগিয়ে গেলাম, মায়ের প্রাণহীণ দেহটা কাপড়ে ঢাকা, পাশে বসে আছে নীলা, তার চোখেও জল।কোন কথা বলতে পারলাম না, শুধু চেয়ে রইলাম... ... শুধুই নির্বাক দৃষ্টি।


জানাযার পরে মাকে দাফন করা হল। সবাই মুঠোমুঠো মাটি দিয়ে একে একে চলে গেল; নির্বাক আমি একাকী দাড়িয়ে। ছোটবোনটা পাশে এসে দাড়াল, চোখ দুটো তখনও জলে ভেজা। আমি পকেট থেকে লটারির কাগজটা
বের করে মায়ের কবরের উপর বিছিয়ে দুমুঠো মাটি দিয়ে ঢেকে দিলাম, মনে মনে বললাম, "রাব্বিরা হামহুমা কামা রাব্বাইয়ানি সাগীরা... ...।" ছোটবোনটার অশ্রুজল তখনো মায়ের কবরটা সিক্ত করে চলছে... ... ...।



[১১মে, "বিশ্ব মা দিবস," আমার এই গল্পটা আমাদের সকল ক্যাডেট মায়েদের উৎসর্গ করছি যারা সেই ছোট্ট ক্লাস সেভেন পড়ুয়া সন্তানটির জন্যে সারাক্ষণ দু:শ্চিন্তায় থাকতেন, তার পথ চেয়ে দিন গুণতেন।]

লেবেলসমূহ: ,

0টি মন্তব্য:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এতে সদস্যতা মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন [Atom]

<< হোম