একুশের পাঠশালায় একজন বৃষ্টি ...
১.
সে অনেক কাল আগের কথা। আজ অনেক দিন পরে যৌবনের সেই টকটকে দিনগুলোর কথা মনে পড়ছে। ইস্ , কী দূর্দান্ত ছিল সেই দিনগুলো!!! আমরা ৬/৭ জন বন্ধু ছিলাম একে অন্যের জানের জান। আর আজ? কে কোথায় আছে, কে জানে! “বৃষ্টি”র জন্যে আজও খুব খারাপ লাগে; না জানি, কেমন আছে বেচারী! রাতুলকে ভালবাসতো ও, খুব ভাল ছেলে ছিল রাতুল। যেমনি চেহারা , তেমনি মেধাবী। আর সাহসটাও ছিল বড্ড বেশি। দেশকে খুব ভালবাসতো ও; সবসময়ই কেবল বলত, “দেশের এই দু:খী মানুষদের জন্য আমাদের কিছু একটা করতেই হবে ... ...” আমরা কেবল হাসতাম ওর কথা শুনে। শুধু বৃষ্টি আস্তে করে বলত, “পাগল কোথাকার!!” আসলে তখন বুঝতে পারিনি, কিন্তু আজ বুঝতে পারছি, ওর সেই কথাগুলো কত মূল্যবান ছিল। তখন ১৯৫০ এর সময়, সারা দেশজুড়ে ছিল ব্যাপক উত্তেজনা, চারিদিকে রাষ্ট্রভাষার সংগ্রাম। ভার্সিটির অবস্থা পুরো গরম। আমরা ছাত্ররা একের পর এক সভা-সমিতি, মিটিং-মিছিল করে চলছি; একটাই দাবী- “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।” রাতুলটার কথা আজও মনে পড়ে, রাতভর শুধু ছাত্রদের মাঝে উত্তেজনা আর সংগ্রামী মনোভাব সৃষ্টির জন্য খেটে মরতো। আহারে, ওর অমন সুন্দর চেহারা দিন দিন বদলে যেতে লাগল। সত্যিই, ওর এক-একটা বক্তৃতা শুনলে মনে হত, এখনই গিয়ে লিয়াকত আলীর জিভটা টেনে ছিড়ে ফেলি। আর ঠিক ওর মত বৃষ্টিও দেখতাম দিনরাত ২৪ ঘণ্টা ছাত্রীদের মাঝে “মাতৃভাষার” গল্প করতো। তবে একটা কাজে ওরা কখনো ভুল করত না, “ফরিদকে পড়তে শেখানো।” ফরিদ রোজ বিকেলে পুকুর পাড়ে বাদাম বিক্রি করত। সেভাবেই ওর সাথে পরিচয়। হঠা্ৎ একদিন রাতুল ফরিদের জন্য বই কিনে আনলো; ওকে পড়তে শেখানো আরম্ভ করল। গণিতে ফরিদ বেশ পারদর্শী ছিল, জীবন যুদ্ধে টাকা গুণতে গুণতে অংকটা খুব ভালই শিখেছিল।
’৫১ এক শুরুতে একদিন বিকেলের কথা; ফরিদ এসে আমাকে বলল, “মাহামুদ ভাই, হুনলাম কি সব ভাষা সংগ্রাম শুরু হইছে, ব্যাপারটা কী কওতো ।” ওকে মোটামুটি বুঝিয়ে বললাম। সব শুনে ও বলল, জন্মের আগেই বাপ গেছে, চাইর বছরে মাও গেল, আর এখন এগারতে মায়ের ভাষাডাও যাইবো ?? বৃষ্টি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে সেদিন বলেছিল, “না, না ,তা হবে না; আমরা সংগ্রাম করে মায়ের ভাষাকে মায়ের বুকেই রাখব ইনশাল্লাহ।” আমার মনে আছে, সেদিনই ফরিদ জীবনে শেষ বাদাম বিক্রি করেছিল; বলেছিল, “আগে সংগ্রাম, ভাষার সংগ্রাম, ভাষা থাইকলে আবার নিশ্চই বাদাম বেচুম।” এরপর থেকে আমাদের প্রতিটা মিটিংয়ে ও উপস্থিত থাকত। কী না করত ছেলেটা ??? পোস্টার লাগানো, চীকা মারা, স... ...ব।
’৫২ এর ২৬শে জানুয়ারি, নাজিমুদ্দিন ঢাকায় এসে আবার শোনালেন সেই পুরোনো কথা, “বাংলা নয়, উর্দূ ... ...।” সংগ্রাম হল আরও উত্তেজিত। ভার্সিটির সবার কাছে কেবল মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজনের চিঠি আসতে লাগল। দুশ্চিন্তা আর দরদভরা সেই সব চিঠি ... ...। কিন্তু লক্ষ্য করলাম, রাতুলের কোন চিঠি আসে না। ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করতেই ও বলল, আত্মীয়-স্বজন বলতে কেউ নেই, কার চিঠি আসবে? ওর বাবা-মা দুজনেই মারা গেছেন, সেটা জানতাম। তাই এমন একটা প্রসঙ্গ টেনে এনে নিজেই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পরলাম। রাতুল বলে যেতে লাগল, এইতো দেশ আছে, তোরা আছিস, এইতো আমার সব। আমি মুচকি হেসে বললাম, আর বৃষ্টি? জবাবে ও শুধু একটু হাসল, মুখে কিছু বলল না।
ফেব্রুয়ারীতে সংগ্রাম আরও জোরদার হল। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্তে আমরা সারা দেশে হরতালের ডাক দিলাম। ১৯ ফেব্রুয়ারী দুপুরে বৃষ্টি আমার হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বলল, “এটা রাতুলকে দিস, বাবা খুব অসুস্থ , আমি বাড়ি যাচ্ছি , তবে খুব তাড়াতাড়ি ফিরব ইনশাআল্লাহ। তোরা সাবধানে থাকিস।” কিন্তু সেই যে গেল, ওর আর ফেরা হল না ... ...
সরকার ২০ তারিখ বিকেল ৩টা থেকে ১৪৪ ধারা জারি করল। ২১ তারিখ সকালে আমরা ১৪৪ধারা ভেঙে মিছিল বের করলাম ... ... সেই ইতিহাস আজ সবার জানা ... মিছিল শেষে অনেকেই ফিরে এল। কেবল যারা ফিরল না, রাতুল তাদের সাথেই গেল। ওরা ক’জন হয়ত প্রতিজ্ঞা করেছিল – ভাষার দাবী নিয়ে প্রয়োজনে খোদার দরবারে যাবে ... তাই চলে গেল। রাতুলের লাশটা কোথায় আছে, তাও জানিনা ... হয়ত কোন গণকবরে বাঙালির চিরন্তন শ্রদ্ধা নিয়ে শুয়ে আছে পরম নিদ্রায়।
পরের কয়েকটা দিন নিজেকে ধরে রাখতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল যেন ভার্সিটি লাইফের সেরা জিনিসটি আমাদের ছেড়ে চলে গেল। হঠাৎ করেই মাঝে মাঝে চোখের সামনে ভেসে উঠত সেই পুকুর পাড়, রাতের আঁধারে রাতুলের জ্বালাময়ী বক্তৃতা, আরও কত কি ! নিজের অজান্তেই গাল বেয়ে দু’ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ত, সে পানি ধরে রাখার সাধ্য আমার আজও হয় নি ... বৃষ্টির কথা মনে হলেই আমি হাউমাউ করে কেঁদে উঠতাম, ওর দেয়া চিঠিটা যে আমি রাতুলকে দেয়ার সুযোগই পাইনি !!! ও ফিরে এলে কি জবাব দেব ওকে ???? আচ্ছা কী লেখা ছিল ঐ চিঠিতে ??? একদিন সাহস করে খুললাম চিঠিটা ... ... মাত্র ২ লাইন... “জরুরী বাড়িতে যাচ্ছি, সাবধানে থেকো।”
বৃষ্টি আর কোনদিন ফিরে আসেনি। আর কোনদিন দেখা হয়নি ফরিদের সাথেও ... ... কোথায় যে হারিয়ে গেল ওরা ... ...
২.
৭১ এর এপ্রিলে কোন এক রাতে মুক্তিযোদ্ধাদের ১০/১২ জনের একটা দল গেরিলা অপারেশনে যাচ্ছি খুলনার পাকশীতে। বেনাপোল থেকে আরও নতুন একজন আমাদের সাথে যোগ দিল। আমিতো অবাক !!! এ যে সেই বাদামওয়ালা ফরিদ ... ... যুদ্ধ আবার আমাদের কাছাকাছি নিয়ে এল। ফরিদ আর আমি একই গ্রুপে ছিলাম প্রায় ৫ মাস। কত স্মৃতি ওর সাথে আমার ... কত গল্প ওর ... যুদ্ধের মাত্র ৭ মাস আগে নতুন বিয়ে করেছিল ও ।যুদ্ধের মাঝে খবর পেয়েছিলাম ওর ছেলে হয়েছে, ফরিদ বউকে চিঠি দিল ... ... ‘ছেলের নাম রাখবা রাতুল ... ...’ কিন্তু নতুন রাতুলকে দেখার সৌভাগ্য তার হয়নি । অক্টোবরের মাঝামাঝি একটা গেরিলা অপারেশনে মারা যায় ফরিদ ... ...
যুদ্ধ শেষ হয়, দেশ স্বাধীন হয়। আমার স্মৃতিতে ফরিদ আজও একজন বাদামওয়ালা ... একজন সহযোদ্ধা ।এখনো রাতুল নামের কোন যুবককে দেখলে আমি আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করি, তোমার বাবার নাম কি ফরিদ ?
৩.
আরও অনেক বছর পরের ঘটনা, স্বাধীনেরও পরে। আশির দশকের মাঝামাঝি কোন এক ২১শে ফেব্রুয়ারি। আমারও বয়স কম হয়নি। আমি আমার ছোট্ট নাতিকে নিয়ে প্রভাত ফেরিতে শহীদ মিনারে ফুল দিতে গেছি । হঠাৎ একজন বয়স্ক মহিলা পেছন থেকে আমার কাঁধে হাত রাখলেন “আমায় চিনতে পারছিস ? আমি বৃষ্টি।” আমার পায়ের নিচ থেকে যেন মাটি সরে গেল। নিজের সবটুকু স্মৃতি দিয়ে ওকে চিনতে চেষ্টা করলাম। কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে জানতে চাইলাম “তুই বেঁচে আছিস? বিয়ে করেছিস? কি করছিস এখন ???” কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর বলল, “বিয়ে ? নাহ্। তা কি আর হয় রে !!! ” ওর গায়ের সাদা শাড়িটা দেখিয়ে বলল, “আমিতো বায়ান্নোতেই বিধবা, যাকে স্বামী হিসেবে বরণ করেছিলাম, সে তো সেই মিছিলেই হারিয়ে গেছে। এই যে আজ ৩২ বছর ধরে এই সাদা শাড়িই আমার দেহটাকে বয়ে বেড়াচ্ছে।” আমি একেবারে নিশ্চুপ। চশমার পুরু কাঁচের ভিতর দিয়ে আমি ওর দিকে চেয়ে আছি অপলক। ও আবার বলতে শুরু করল, “স্বাধীনের পরে গ্রামে একটা পাঠশালা করেছি, নাম দিয়েছি “একুশের পাঠশালা”, গ্রামের দুষ্টু-ডানপিটে ছেলেদের আমি পড়াই। আমারতো আর সন্তান নেই, ওরাই আমাকে ‘মা’ ডাকে। ” ওর কথাগুলো আমার হৃদয় কাঁপিয়ে তুলল। বুঝতে পারলাম, সন্তানের মুখে ‘মা’ ডাক শোনার জন্যে প্রতিটি নারীর যে ব্যাকুলতা, বৃষ্টির হৃদয়েও আছে তার নীরব স্পন্দন, তাইতো বিশ্বমায়ের সব সন্তানকেই ও বুকে টেনে নিয়েছে। আমার দুচোখ বেয়ে অঝোরে বেড়িয়ে এল জল ... ... বৃষ্টি মৃদু হেসে বলল, “কাঁদিস কেন রে বোকা ? আজতো আমাদের খুশির দিন। দেশ আজ স্বাধীন, আমাদের ভাষা বাংলা। রাতুলরাতো এটাই চেয়েছিল, তাই না ?” একটা কাগজে ওর পাঠশালার ঠিকানা ধরিয়ে দিয়ে বলল, “সময় পেলে আসিস, আমি আজই ফিরে যাব, হাতে খুব বেশি সময় নেই। ” আমি কিছু বলার আগেই ও দ্রুত ভীড়ের মাঝে মিলিয়ে গেল। আমি অপলক তাকিয়ে রই শহীদ মিনারের দিকে, শত শত মানুষ সেখানে। কিন্তু এরা কেউই জানে না, ঐ বৃদ্ধা রমণীর হৃদয়টা কতটা ক্ষত-বিক্ষত! কতটা বেদনায় ভরা !
বৃষ্টির সেদিনের কথাগুলো আজও আমার কানে ভাসে। প্রতি বছর একুশ আছে। আমার কেবলই মনে পড়ে ওদের কথা। রাতুল, বৃষ্টি , ফরিদ, সেই পুকুর ঘাট, সেই মিছিল, সেই যুদ্ধ ... ... ওরা যেন আজও আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকে। আমি কেবল তাকিয়ে রই শহীদ মিনারের দিকে ... ... না জানি, কত অজানা গল্প লুকিয়ে আছে এর প্রত্যকটি ইটের মাঝে ... .... ...
================================================
[বাস্তবের কোন চরিত্রের সাথে এ কাহিনীর কোন সম্পর্ক নেই।]
[এমন সব বিচ্ছিন্ন ঘটনাই জন্ম দিয়েছে কিছু ইতিহাসের।]
[এমন অনেক অজানা বেদনাই ৫২ থেকে ৭১ এর ইতিহাস।]
লেবেলসমূহ: ১৯৫২, একুশ, ভাষা আন্দোলান